আদিখণ্ড

তৃতীয় তরঙ্গ

বন্দনা

জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।

 

যশোমন্ত ঠাকুরের বৈষ্ণব সেবা ও বৈষ্ণব দাসের পুনর্জীবন

পয়ার

তস্য পরে জনমিল শ্রীবৈষ্ণব দাস।
বৈষ্ণব দাসের পরে জন্মে গৌরীদাস।।
সবার কনিষ্ঠ হ’ল শ্রীস্বরূপ দাস।
জগৎ পবিত্র কৈল হইয়া প্রকাশ।।
ত্রেতাযুগে প্রকাশ হইল চারি অংশে।
এবে এসে প্রকাশ হইল পঞ্চ অংশে।।
যশোমন্ত সদা দেন বৈষ্ণব ভোজন।
একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটন।।
একাদশী দিনে সব বৈষ্ণব আসিল।
কৃষ্ণ প্রেমানন্দে হরি বাসর করিল।।
নাম সংকীর্ত্তনে মত্ত বৈষ্ণবের দল।
সঙ্গে সঙ্গে যশোমন্ত বলে হরিবোল।।
বয়স বৈষ্ণব দাস চতুর্থ বৎসর।
একাদশী দিনে গায় আছে কিছু জ্বর।।
পারণা দিবসে হরি বাসর প্রভাতে।
পুকুরের ঘাটে গেল হাটিতে হাটিতে।।
পুকুরের জলে পড়ি মরিল বালক।
এদিকে বৈষ্ণবগণ প্রেমেতে পুলক।।
দেবী অন্নপূর্ণা দেখি কাঁদিয়া উঠিল।
যশোমন্ত এসে মুখ চাপিয়া ধরিল।।
কান্না শুনি বৈষ্ণবের সুখ ভঙ্গ হবে।
না হ’বে বৈষ্ণব সেবা সব বৃথা যা’বে।।
মরেছে বালক যদি এখানে থাকুক।
অগ্রে সব বৈষ্ণবের পারণা হউক।।
মরা পুত্র যশোমন্ত গৃহে রাখে সেরে।
বৈষ্ণবের সঙ্গে গিয়া হরিনাম করে।।
নাম সংকীর্ত্তনে মত্ত বৈষ্ণবের দল।
সঙ্গে সঙ্গে যশোমন্ত বলে হরিবোল।।
নাম সংকীর্ত্তন হ’ল পারনা হইল।
সবে ভোগ দরশন করিতে আসিল।।
মৃত পুত্র শিরে করি নাচিছে সুধীর।
অন্নপূর্ণা দেবী তবে কাঁদিয়া অস্থির।।
যশোমন্ত বলে তুমি কাঁদ কেন মিছে।
বৈষ্ণব সেবার কালে বালক ম’রেছে।।
ধন্য রত্নগর্ভা তুমি তোমার উদরে।
এহেন বালক জন্মে আমাদের ঘরে।।
আমার ঔরস ধন্য তাতে জানা গেল।
বৈষ্ণব সেবার কালে বালক মরিল।।
হেন ভাগ্য কার হয় জনম লইয়া।
বৈষ্ণব সেবায় মোরে কীর্ত্তন শুনিয়া।।
বৈষ্ণব হইয়া বরং বাঁচে পঞ্চদিন।
বৃথা সহস্রেক কল্প হরিভক্তিহীন।।
সকল বৈষ্ণব সেবা হইল স্বচ্ছন্দ।
মৃত পুত্র তথা আনি বাড়িল আনন্দ।।
মৃত পুত্র শিরে নাচে পুলক শরীর।
বৈষ্ণবেরা বলে কি হইল বৈরাগীর।।
এক সাধু বলে শুন যত সাধুগণ।
কি কহিব বৈরাগীর মরিল নন্দন।।
সবে বলে এ বালক মরিল কখন।
তিনি কন তোমাদের কীর্ত্তন যখন।।
জলেতে পড়িয়া পুত্র মরেছে তখন।
এই সে মরা পুত্র মস্তকে ধারণ।।
ডাক দিয়া যশোমন্তে বৈরাগীরা কয়।
মৃত ছেলে কি কারণে রাখিলে মাথায়।।
বৈষ্ণবের কথা শুনি যশোমন্ত বলে।
মরেছে বালক মম সাধু সেবা কালে।।
সাধু সেবা হরি নাম শুনে শিশু মরে।
পুত্র নয় সাধু বলে রাখিয়াছি শিরে।।
মরেছে বালক তাতে নাহিক বিষাদ।
মম ভয় বৈষ্ণবের সেবা হয় বাদ।।
সে কারণে না জানাই বৈষ্ণব সমাজে।
মড়া পুত্র গোপনে রাখিনু মাঝে।।
হইল বৈষ্ণব সেবা আনন্দ হৃদয়।
এবে আনিলাম ছেলে বৈষ্ণব সভায়।।
মৃত পুত্র লয়ে নাচে আনন্দিত মন।
বালকের মুখে হৈল জল উদ্গীরণ।।
বালকের মৃত দেহে সঞ্চারে জীবন।
ধন্য ধন্য করি হরি বলে সাধুজন।।
অন্নপূর্ণা বাঞ্ছাপূর্ণ পুত্র নিল কোলে।
রচিল রসনা মৃত্যুঞ্জয় কৃপা বলে।।

 

মোহমুদগরোপখ্যান

পয়ার

পুনঃ বৈষ্ণবেরা বসিলেন একঠাঁই।
বলে ধন্য যশোমন্ত হেন দেখি নাই।।
মোহ মুদ্গরের বাটি শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন।
কৃষ্ণভক্তি বুঝিবারে গেলেন দুজন।।
ব্রাহ্মণ বেশেতে গিয়া উপনীত অতিথি।
মুদ্গরে ডাকিয়া বলে আমরা অতিথি।।
অতিথিরে দিল সাধু পাক করিবারে।
তিন পুত্র পাঠাঁইল পরিচর্যা তরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র গিয়াছিল জল আনিবারে।
অকস্মাৎ সেই পুত্র খাইল কুম্ভিরে।।
মধ্যম সন্তান গেল কাষ্ঠ আনিবারে।
বন মাঝে ব্যাঘ্র ধরি মারিল তাহারে।।
কনিষ্ঠ সন্তান গেল আনিবারে পাত্র।
কালসর্প তাঁর শিরে করিল আঘাত।।
পুত্রের বিলম্ব দেখি মুদ্গর চলিল।
সাপে বাঘে কুমিরে মেরেছে দেখে এল।।
এই ভাবে তিন পুত্র মরে গেল তাঁর।
নিজে এনে দ্রব্য দিল অতিথি সেবার।।
মুদ্গরের নারী আর পুত্রবধু তিন।
নহে তারা শোকাতুরা বিকারবিহীন।।
ছদ্মবেশে কৃষ্ণ বলে শুন মহাশয়।
কাষ্ঠ পাতা আনতে গেল তাহার কোথায়।।
মুদ্গর কহিছে তারা মহা ভাগ্যবান।
অতিথি সেবাতে তারা ত্যজিয়াছে প্রাণ।।
কৃষ্ণ বলে ম’ল তব তিনটি নন্দন।
পুত্র শোকে মুদ্গর কাঁদনা কি কারণ।।
মুদ্গর কহিছে কেন করিব রোদন।
পুত্র ম’ল ভাল হ’ল ঘুচিল বন্ধন।।
মায়ার বন্ধন কেটে দিলেন গোবিন্দ।
নির্বিঘ্নে বলিব হরি করিব আনন্দ।।
কৃষ্ণ বলে শীঘ্র যাও ডেকে আন ঘরে।
অতিথি সেবাতে কবে কার পুত্র মরে।।
যারে নিল কুম্ভীরেতে উপজিল আসি।
কৃষ্ণ অগ্রে এনে দিল জলের কলসী।।
এই মত তিন পুত্র হ’ল উপনীত।
হরি পদ ধরি সব ধূলায় লুণ্ঠিত।।
পরিচয় দিয়া হরি করিল গমন।
অভিমন্যু শোক পার্থ কৈল সম্বরণ।।
মুদ্গরের পুত্র দিল গোলোক গোঁসাই।
যশোমন্ত বৈরাগীর আজ হ’ল তাই।।
আর সাধু বলে শুন বৈষ্ণবের গণ।
কৃষ্ণলীলা সুধাধার মধুর বর্ষণ।।
অম্বরীষ গৃহে ছিল একটি নন্দন।
দশ বর্ষ পরমায়ু ছিল নিরূপণ।।
সংক্ষেপে বলিব এবে তাঁর বিবরণ।
সূতিকা আগারে যবে ছিল সে নন্দন।।
অদৃষ্ট লিখন যবে লেখে পদ্মাসন।
দাসী গিয়া ধরিল সে বিধির চরণ।।
দাসী বলে ওহে বিধি কি লিখিয়া যাও।
বালকের আয়ু কত মম ঠাঁই কও।।
অনেক স্তবেতে বিধি সন্তুষ্ট হইল।
দশ বর্ষ পরমায়ু দাসীকে বলিল।।
দাসী জানাইল রাজরানীর গোচরে।
রানী জানাইল তাহা মহারাজ তরে।।
অল্প আয়ু জানি নাহি দিল লিখিবারে।
মনে মনে চিন্তা করে রাজার কুমার।।
ভাবে আমি রাজকূলে একটি কুমার।।
পিতা না করেন যত্ন মোরে লেখাবার।।
রাজপুত্র জিজ্ঞাসিল পিতৃদেব স্থলে।
কেন পিতা মোরে নাহি দেন পাঠশালে।।
রাজা বলিলেন সেই বালকের ঠাঁই।
দশবর্ষ আয়ু আছে বাছা লেখাব কি ছাই।।
দশবর্ষ পরমায়ু তোমার যে ছিল।
নয় বর্ষ এই তার গত হয়ে গেল।।
রাজপুত্র বলে পিতা আর শুনিব কি।
এখনতো মরণের একবর্ষ বাকি।।
এই ভিক্ষা চাই পিতা আমি যদি মরি।
একবর্ষ প্রজা লয়ে বলি হরি হরি।।
খেতে দিবা প্রজাগণ না লইবা কর।
এই ভিক্ষা চাই পিতা একটি বৎসর।।
স্বীকার করিল রাজা সন্তোষ অন্তরে।
প্রজাবর্গ লয়ে শিশু হরিনাম করে।।
মরণের কাল তার হইল যখন।
তাহাকে লইতে এল রবির নন্দন।।
হরিভক্ত শিশু নিতে যম উপস্থিত।
ভক্ত বৎসল হরি অন্তরে দুঃখিত।।
হরি এসে বালকেরে করিলেন কোলে।
মুখ দেখে কমলাখি ভাসে আঁখি জলে।।
শমন বলেন হরি কারে কর কোলে।
আয়ু শেষ ফেলে দাও ল’য়ে যাই চলে।।
হরি ক’ন শেষে এ বালকে লয়ে যাও।
অগ্রেতে তলব খাতা আমাকে দেখাও।।
শমন তলব খাতা হরিকে দেখায়।
দশবর্ষ আয়ু দেখে কাঁদে দয়াময়।।
কৃষ্ণের নয়ন জলে কজ্জল যে ছিল।
নয়নের জলে তাহা গলিত হইল।।
সেই ত্রিভঙ্গের ভঙ্গি কেবা তাহা জানে।
কজ্জলাক্ত অশ্রু পড়ে আয়ুর দক্ষিণে।।
হরি কন শতবর্ষ পরমায়ু দেখি।
যম বলে তবে চিত্রগুপ্ত বলিল কি।।
চিত্রগুপ্ত হাঁতে নিয়া দেখে সেই খাতা।
ক্রোধেতে কম্পিত গুপ্ত ঝাকি দিল মাথা।।
চিত্রগুপ্ত কর্ণেতে লেখার তুলী ছিল।
আয়ুর দক্ষিণে মসি দুইবিন্দু প’ল।।
দুইশূন্য শতাঙ্কের দক্ষিণে পতন।
অযুত বৎসর আয়ু পাইল নন্দন।।
হরিলীলামৃত কথা অমৃত সমান।
তারক কহিছে সাধু সুখে কর পান।।

 

জয়পুর রাজ কুমারের পুনর্জ্জীবন

পয়ার

এইরূপ জয়পুর মান সিংহরায়।
তাহার হইল সুত সুতিকালয়।।
এরূপে দাসীকে ধাতা দিল দরশন।
বালকের জানিলেন আয়ু বিবরণ।।
পরমায়ু ছিল তার উনিশ বৎসর।
মাঝে মাঝে কাঁদে দাসী হইয়া কাতর।
অষ্ঠাদশবর্ষ আয়ু হইল যখন।
পাঠশালা হতে গৃহে আসিল নন্দন।।
বালকে করিয়া কোলে দাসী যবে কাঁদে।
রাজপুত্র সুধায়েছে ধরি তার পদে।।
দাসী বলে মম মনে অনেক সন্তাপ।
তোমার কল্যাণ হেতু কাঁদি ওরে বাপ।।
বলিতে না পারে দাসী মুখে না জুয়ায়।
রাজপুত্র কাতরে দাসীরে ধরে পায়।।
আমার শপথ লাগে করি প্রণিপাত।
সত্য করি কহ মম শিরে দিয়া হাত।।
ধাত্রী বলে কি বলিব শুন বাছাধন।
উনিশ বৎসরে হবে তোমার মরণ।।
আঠার বৎসর গত একটি বৎসর।
বাকি মাত্র আছে বাছা পরমায়ু তোর।।
শুনিয়া বালক বলে শুন ধাত্রী মাই।
বিশ্বেশ্বর দরশনে তবে আমি যাই।।
মার্কণ্ডের পরমায়ু বার বৎসর ছিল।
শঙ্কর কৃপাতে আয়ু সপ্তকল্প হ’ল।।
তার পিতা তাহারে দিলেন বনবাস।
হরি হরি বলিয়া কাটিল কর্ম ফাঁস।।
প্রস্তাব রয়েছে তার মার্কণ্ডপুরাণে।
হরি বলে মার্কণ্ড কাঁদিল বনে বনে।।
মার্কণ্ড নারদ সঙ্গে গেলেন কৈলাসে।
হেন কালে শমন তাহারে নিতে আসে।।
চর্ম্ম রসি কসে তার গলে বেঁধে দিল।
শিবলিঙ্গ বাম হাঁতে জড়ায়ে ধরিল।।
শিব এসে মহা রোষে ভক্ত নিল কোলে।
যম বক্ষ পরে তীক্ষ্ণ শূল নিক্ষেপিল।।
দুর্গতি নাশিনী দুর্গা শিশু নিল কোলে।
মাতৃ কোলে মার্কণ্ড শ্রী হরি হরি বলে।।
সদয় হইয়া বর দিল দিগম্বর।
বলে এর পরমায়ু সপ্ত মন্বন্তর।।
শিব যদি বর দিল যম গেল ফিরে।
সপ্তকল্প পরমায়ু সপ্ত মন্বন্তর।।
তব সম দয়ানিধি ভবে কেবা আছে।
শঙ্কর দয়ালু আর দয়ালু শ্রীহরি।।
শ্রীহরি বলিয়া মাগো করিব শ্রীহরি।।
স্বচক্ষেতে বিশ্বনাথ দরশন করি।
শমন দমন করি বলে হরি হরি।।
মাতা পিতা ধাত্রীকে বসায়ে এক ঠাঁই।
বলে মা বিদায় দেহ কাশীধামে যাই।।
আধ্যাত্মিক ভাবেতে সকলে বুঝাইল।
রাজপুত্র কাশীধামে গমন করিল।।
একবর্ষ কাশীধামে করে হরিনাম।
কিবা দিবা বিভাবরী না করি বিরাম।।
যে দিনেতে কুমারের আসন্ন সময়।
আনন্দ কাননে বসি হরিগুণ গায়।।
এসে পরে বিশ্বেশ্বর করে দরশন।
বহুস্তবে তোষে ভবে করিয়া রোদন।।
সিদ্ধ ঋষি তথা বসি বিশ্বেশ্বর দ্বারে।
রাজপুত গিয়া তথা তার পদ ধরে।।
পরমহংস, অবতংশ উলঙ্গ সন্ন্যাসী।
দীর্ঘজীবী তুই হবি বর দিল হাসি।।
রাজপুত্র বলে সুত পরমায়ু নাই।
সহস্রায়ু তোর আয়ু বলিল গোঁসাই।।
হেনকালে সেই সাধু গঙ্গা স্নানে যায়।
রাজপুত্র হাঁচি দিল এমন সময়।।
হাঁচি শুনি সাধু শিরোমণি দিল বর।
জীবন সহস্র বলে করে ধরে কর।।
রাজপুত্র সাধুর চরণ গিয়া ধরে।
আজ মম মৃত্যু ব’লে ভাসে অশ্রুনীরে।।
সাধু বলে হরি যে দিয়াছে হাঁচি।
জীবন সহস্র আমি তাহারে বলেছি।।
রণে বনে গমনে ভোজনে স্নানে দানে।
হাঁচিতে সুফল বেদের বিধানে।।
পশ্চিমে পরিলে হাঁচি বহু লভ্য হয়।
পশ্চিমেতে হাঁচি প’ল স্নানের সময়।।
হরিনাম ধ্বনি তোর ভক্তি রসময়।
তাতে তোর হাঁচি শুনে প্রফুল্ল হৃদয়।।
জীবন সহস্র মম মুখেতে আসিল।
কুমার তোমার ভাগ্য প্রসন্ন হইল।।
রাজপুত্র বলে মম অবশ্য মরণ।
বলিতে বলিতে তথা আইল শমন।।
মহিষ বাহন যম কালদণ্ডাকারে।
রাজপুত্র বলে ঐ নিতে এল মোরে।।
সাধু বলে চল শঙ্করের কাছে যাই।
দেখি বাক্য রাখে কি না শঙ্কর গোঁসাই।।
হেনকালে অন্নপূর্ণা বলে মৃদু হাসি।
দৈববানী প্রায় যেন বলিল প্রকাশি।।
বহুদিন করে সাধু সাধন ভজন।
সত্য সত্য সাধু বাক্য না হ’বে লঙ্ঘন।।
বিশ্বেশর বলে তুমি শুন ব্রহ্মময়ী।
তুমি যাহা বলিলে আমার বাক্য অই।।
সাধু বলে ধর্মরাজ শুনিতে কি পাও।
রাজপুত্র পরিবর্তে মম প্রাণ লও।।
শঙ্করী শঙ্কর বাক্য আমি দিনু বলে।
তিনবাক্য নষ্ট হয় রাজপুত্র নিলে।।
যম বলে তব বাক্যে ছাড়িনু কুমারে।
নির্ভয়েতে হরিভক্ত যাক নিজ ঘরে।।
রাজপুত্র চলে গেল আপন ভবনে।
বন্দিলেন পিতা মাতা ধাত্রীর চরণে।।
দুরন্ত কৃতান্ত শান্ত এ বৃতান্ত শুনি।
জয়পুরে প্রেমানন্দ জয় জয় ধ্বনি।।
ধাত্রীবাক্যে পরে করে মহা মহোৎসব।
হরি বলে নৃত্য করে যতেক বৈষ্ণব।।
আর দেখ কর্ণ পুত্র বৃষকেতু ছিল।
করাতে কাটিয়া তারে কৃষ্ণ পূজা কৈল।।
সেই পুত্র বাচালে কৃষ্ণ ভগবান।
কেন না বাচিবে বল এ ছেলের প্রাণ।।
কত মতে সাধু সেবা কৈল যশোমন্ত।
কেন ছেলে বাচিবেনা ভক্তি করে।।
বৈষ্ণবের সুখভঙ্গ এই ভয় করে।
দুঃখ নাই মড়া ছেলে সেরে রাখে ঘরে।।
যশোমন্ত পুত্র দিল অন্নপূর্ণা কোলে।
পতিপদ ধরি সতী হরি হরি বলে।।
ওহে নাথ এ তনয় আমার তো নয়।
ছেলের জীবন পেল বৈষ্ণবের কৃপায়।।
এছেলে থাকুক সাধু সেবায় নিযুক্ত।
বৈষ্ণবের নফর হউক বৈষ্ণবের ভক্ত।।
বৈষ্ণবের দাস হবে মম অভিলাস।
এ ছেলের নাম থাক শ্রীবৈষ্ণব দাস।।
পরে গৌরীদাস পরে শ্রীস্বরূপ দাস।
এক বিষ্ণু পঞ্চঅংশে ভুবনে প্রকাশ।।
পঞ্চভাই জন্ম নিল ভুবনের মাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

 

প্রভুদের বাল্য খেলা
পয়ার


ফরিদপুর জিলা গ্রাম সফলা ডাঙ্গায়।
পঞ্চভ্রাতা জন্মিলেন এসে এ ধরায়।।
প্রভু আগমনে ধন্য হ’ল মত্ত্যপুরী।
বঙ্গদেশে ধন্য গ্রাম সফলা নগরী।।
অগ্রগন্য কৃষ্ণ দাস ভজনেতে।
শুদ্ধ্বাচারী কৃষ্ণ ভক্তে আর্তি বৈষ্ণবেতে।।
একাদশী উপবাসী তুলসী ভজন।
শ্রীহরি বাসর হরিব্রত পরায়ন।।
নাম সংকীর্ত্তন আদি সদা সাধু সঙ্গ।
অন্তরে মাধুর্য শুধু প্রেমের তরঙ্গ।।
বৈষ্ণব দাসের মন শুধু বৈষ্ণব সেবায়।
বৈষ্ণবের সঙ্গে রঙ্গে কৃষ্ণ গুণ গায়।।
প্রভুর অংশেতে জন্ম ভক্তি যুক্ত কায়।
ভক্তের হইয়া ভক্ত ভক্তি শিখায়।।
স্বয়ং এর প্রতিজ্ঞা এ চিরদিন রয়।
ভক্তের হইতে ভৃত্য মোর বাঞ্ছা হয়।।
জানেনা বৈষ্ণব দাস সাধু সেবা বিনে।
গৃহেতে বৈষ্ণব দাস সাধু সেবা দিনে।।
জিজ্ঞাসা করিত মাতা অন্নপূর্ণা ঠাঁই।
বলে মাগো আজ তো বৈষ্ণব আসে নাই।।
বৈষ্ণবের পাক করা লাবড়া ব্যঞ্জন।
বৈষ্ণব প্রসাদ নিতে বড়ই মনন।।
বৈষ্ণবে নিঃশ্বাস ছাড়ে হরে কৃষ্ণ বলে।
তখন আমার মনে আনন্দ উথলে।।
যার গলে মালা ভালে তিলক ধারন।
তারে গিয়া করিত বৈষ্ণব সম্বোধন।।
বালক নিকট যেত বাল্য খেলা লাগি।
বলে ভাই এস খেলি বৈরাগী বৈরাগী।।
একত্র হইয়া সব বালকের সনে।
বলে ভাই ভালো মাটি পাবো কোন খানে।।
যে স্থানে বিশুদ্ধ মাটি আনিত তুলিয়া।
অষ্টাঙ্গে লইত ফোঁটা সে মাটি গুলিয়া।।
বৈষ্ণবেরা যেমন পরিত বহির্বাস।
তেমতি পরিত নিজ পরিধান বাস।।
তুলসির চারা আনি করিত রোপণ।
বলে ভাই হেথা কর নাম সংকীর্ত্তন।।
হরি বলি বাহুতূলি নাচিয়া নাচিয়া।
ভূমে দিত গড়াগড়ি মাতিয়া মাতিয়া।।
নামরসে খেলা বশে মত্ত সুধা পানে।

আহারাদি ক্ষুদা তৃষ্ণা না থাকিত মনে।।
গৌরীদাস গুণভাষ কহন না যায়।
অহরহ বদনেতে হরি গুণ গায়।।
থাকিতেন বৈষ্ণবদাসের হয়ে অনুগত।
বৈষ্ণব দেখিলে হইতেন পদানত।।
মাতৃ পিতৃ আজ্ঞা মানি করিতেন কার্য্য।
ভাতৃগণ আজ্ঞা করিতেন শিরধার্য্য।।
পৌগণ্ডেতে বালকের সঙ্গেতে মিশিয়া।
হরি হরি বলিতেন নাচিয়া নাচিয়া।।
স্বরূপ দাসের বাল্য লীলা চমৎকার।
পিতৃ সেবা মাতৃ সেবা বিশুদ্ধ আচার।।
ভাতৃগণ আজ্ঞাধীন সদা করে কায্য।
ভৃত্যবৎ ভ্রাতৃ পরিচরজাদি গাম্ভীর্য।।
অতিথি বৈষ্ণব পেলে করিত সেবন।
বালক বৈষ্ণব সঙ্গে নাম সংকীর্ত্তন।।
অষ্টাবিংশ মন্বন্তরে পুষ্পবন্ত কলি।
কাঁচা মধু পূর্ণ অফুটন্ত পুষ্প কলি।।
শ্রীহরি ভাস্কর জ্যোতি তাতে ভাতি দিল।
পুষ্পবন্ত কলি “ফুল্ল” জগৎ মাতিল।।
পুষ্পবন্ত কলি ধন্য বৈষ্ণবোপসনা।
সে রসে রস না কেন তারক রসনা।।

 

মহাপ্রভু শ্রীহরিচাঁদের বাল্যলীলা

পয়ার


এইভাবে চারিভাই করে বাল্য খেলা।

এবে শুন মহাপ্রভুর স্বীয় বাল্যলীলা।।

মহাপ্রভু বাল্যকালে রাখিতেন গরু।

ধরিয়া গোপালবেশ বাঞ্ছাকল্পতরু।।

আবাধ্বনি দিয়া করে ধরিতেন তাল।

আনন্দে করিত নৃত্য গোধনের পাল।।

গোপনীয় ভাব যেন ছিল বৃন্দাবনে।

করিত তেমনি খেলা রাখালের সনে।।

ব্রজেতে যেমন ভাব ছিল ভঙ্গী বাঁকা।

সেইভাবে দাঁড়াতেন যষ্টি দিয়া ঠেকা।।

ভাব দেখে রাখালেরা জিজ্ঞাসিত নাম।

বলিতেন নাম কৃষ্ণ দূর্বাদল শ্যাম।।

 

মহাপ্রভু শ্রীশ্রীহরিচাঁদের গোপালবেশ

ত্রিপদী


যখন পৌগণ্ডলীলা,        রাখালের সঙ্গে খেলা,

করিতেন গোষ্ঠ গোচারণ।

গোপাল পাল হইতে,      বাহুড়ী গেলে দূরেতে,

আবাধ্বনি করিত তখন।।

আবাধ্বনি শ্রুত হ’য়ে,      গাভী বৃষভ আসিয়ে,

তৃণ বারি খাইত একত্রে।

প্রভু কহে গাভী এড়ে,     যাইতে না পারে এঁড়ে,

বাঁধা আছে অলক্ষিত সূত্রে।।

কখন রাখালগণে,          কহিত আনন্দ মনে,

হরিচাঁদ বাঞ্ছাকল্পতরু।

রাখালের প্রাণধন,         হে নটবর! রঞ্জন,

নাটুয়া নাচাও  দেখি গরু।।

হরিচাঁদ বলে ভাই,         তোমাদের জ্ঞান নাই,

গরু নাচে মানুষের বোলে।

রাখালেরা কহে বাণী,      আমরা তোমারে মানি,

ওরা মানিবে না কিবা বলে।।

হরিচাঁদ বলে কথা,        সকলে আসিয়া হেথা,

ধেনু রাখি, যতেক রাখালে।

মানুষে মানুষ মানে,       পশু না’চাব কেমনে,

আমি নহে বাজীকরের ছেলে।।

রাখালেরা বলে বুঝি,      নিত্য যে দেখাও বাজী,

বাজীকর তুমি মন্দ নয়।

আবাধ্বনি দিয়া কেন,     পালের গোধন আন,

তারা কি ডোরেতে বন্ধ রয়।।

তুমি রাখালের রাজা,      আমরা তোমার প্রজা,

মোরা প্রজা ওরা কি প্রজা না।

আমরা বাক্য মেনেছি,    নাচা’লে আমরা নাচি,

মোরা নাচি ওরা কি নাচে না।।

আমরা বাথানে থাকি,     তব বাক্যে ধেনু রাখি,

পাল হ’তে অন্য ঠাই যায়।

দে, ব’লে দর্প করিলে,    অমনি ফিরিয়া চলে,

ফেরে দেখি মোদের কথায়।।

হলধর হাল চাষে,         দাপটে ফিরিয়া আসে,

চাষে বৃষে মাঠে ঘাটে রাখা।

রাখালেরা মনঃক্ষুন্ন,       ইচ্ছামত পূর্ণব্রহ্ম,

দেখা-দেখা না দেখা না দেখা।।

রাখালের কথা শুনি,       রাখালের শিরোমণি,

আবাধ্বনি দিয়া দাঁড়াইল।

পিছে পাঁচনী ঠেকায়ে,     পদ পরে পদ দিয়ে,

ফিরাইয়া কবরী বাঁধিল।।

রাখালে বলে ডাকিয়া,     নাচ আমারে ঘেরিয়া,

হুকাড়িয়া গোপালে দে হাঁক।

আবাধ্বনি ক’রে ক’রে,    সবে ফুকারে ফুকারে,

উচ্চৈঃস্বরে কৃষ্ণ বলে ডাক।।

শুনিয়া রাখাল সবে,       কৃষ্ণ বলে উচ্চরবে,

নৃত্য করে ঠাকুরে ঘেরিয়া।

গো-গণের মুখ উচ্চ,       উচ্চ কর্ণ উচ্চ পুচ্ছ,

নৃত্য করে নাচিয়া ধাইয়া।।

কখন বা নিজালয়,        কখন মাতুলালয়,

করিতেন গোষ্ঠ গোচারণ।

গোষ্ঠেতে দেখিলে সর্প,   করিতেন ঘোর দর্প,

ধেয়ে গিয়া করিতেন ধারণ।।

দেখি ঠাকুরের দর্প,        পালাইত কাল সর্প,

কোন সর্পে ধরিতেন ফণী।

ঠাকুর পানে চাহিয়ে,      সভয় প্রণাম হ’য়ে,

ফিরে দূরে যাইত অমনি।।

কোন ফণী বৃক্ষ পরে,      ঠাকুর দেখিলে পরে,

বলিতেন রাখালগণেরে।

এনে দেরে বেত্র শিষ,     তোরা অন্তরে থাকিস,

আমি আনি অই ফণী ধরে।।

শিষ অগ্র ফিরাইয়া,        তাতে এক গ্রন্থি দিয়া,

ফাঁসি বানাইয়া ধরে ফণী।

ফণী টানিয়া আনিয়া,      গোষ্ঠের মাঝেতে গিয়া,

ছেড়ে দিয়া খেলিত অমনি।।

গাইত পদ্ম-পুরাণ,         মনসা ভাসাণ গান,

বেহুলার করুণ কাহিনী।

রাখালে দিতেন বলি,      আমি সাপ ল’য়ে খেলি,

তোরা নাচ দিয়া হরিধ্বনি।।

হরিচাঁদের শ্রীঅঙ্গ,         হেরিয়া কাল ভুজঙ্গ,

আর শুনি মনসার গান।

সর্পের চক্ষের জল,        বহি যায় ছল ছল,

রাখালেরা হেরে হতজ্ঞান।।

দেখে রাখালেরা বলে,     সাপুড়ে মন্ত্র শিখিলে,

কহ হরি কাহার নিকটে।

ঠাকুর কহিল সর্বে,         ওরা যথা ছিল পূর্বে,

ভ্রমণ করেছি তার তটে।।

ওরা বড় ছিল খল,        আমি দিনু প্রতিফল,

কাত্যায়নী নাম মন্ত্র গুণে।

দমন করেছি কালী,       সেই হ’তে চিরকালি,

দেখে চিনে নাম শুনে মানে।।

নাটু আর বিশ্বনাথ,        থাকিত ঠাকুর সাথ,

হরিচাঁদ প্রেমে বড় আর্তি।

যেখানে সেখানে যেত,    সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইত,

কার্য করে আজ্ঞা অনুবর্তী।।

লইয়া রাখালগণ,                    করে গোষ্ঠ গোচারণ,

কভু বসে বৃক্ষের ছায়ায়।

আপনি হইয়া রাজা,       খেলিতেন রাজা প্রজা,

এদিকে গোধন তৃণ খায়।।

যেই ভাব বৃন্দাবনে,        খেলিতেন গোবর্ধনে,

সেই ভাবে এবে গোপালক।

হরিচাঁদ কৃপালেশে,        পাগলচাঁদ আদেশে,

হরি লীলা রচিল তারক।।

 

রাখাল বিশ্বনাথের জীবন দান

পয়ার


একদিন শুন এক আশ্চর্য ঘটনা।

বিশ্বনাথ নামেতে রাখাল একজনা।।

গোধন চরাতে বিশ্বনাথ সাথে যায়।

সর্বক্ষণ ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে রয়।।

যখন যে খেলা করে রাখাল স্বভাব।

তার মধ্যে মধুমাখা ঈশ্বরীয় ভাব।।

ঠাকুর থাকেন এক স্থানেতে বসিয়ে।

সবে মিলে খেলে আজ্ঞা অনুবর্তী হয়ে।।

রাখালেরা মিলিয়া বারিক করি লয়।

এক জন রাখে গরু বারিক সময়।।

প্রভু দেন আজ্ঞা করে শুন রে রাখাল।

ফিরাইয়া আন গিয়া গোধনের পাল।।

প্রভু দেন আজ্ঞা করে রাখালেরা শুনে।

ঠিক যেন পূর্ব ভার গিরি গোবর্ধনে।। (পূর্বভাব)
বিশ্বনাথ নামে এক রাখাল চতুর।

আত্মা সম ভাল তারে বাসিত ঠাকুর।।

সকল রাখাল এল গোষ্ঠ গোচারণে।

বিশ্বনাথ এল না দৈবের নির্বন্ধনে।।

ঠাকুর বলেন তবে সব সখাগণে।

সকলে আসিলি তোরা বিশে কোনখানে।।

নাটু কহে ওহে হরি কি কহিব আর।

আসিলাম বলিতে বিশের সমাচার।।

বিশের হ’য়েছে রাত্রে বিসূচিকা ব্যাধি।

মৃতপ্রায় সকলে করিতেছে কাঁদাকাঁদি।।

ঠাকুর বলেন নিদানের কর্তা আমি।

বিশাইর কি করিবে তুচ্ছ ভেদবমি।।

নাটুকে করিয়া সঙ্গে ঠাকুর চলিল।

হেনকালে বিশ্বনাথ অজ্ঞান হইল।।

বিশাইর হইয়াছে মৃত্যুর লক্ষণ।

ঘনশ্বাস বহে তার উত্তার নয়ন।।

বিশাইর জ্ঞাতি বন্ধু বলেছে সকলি।

বিশারে বাহিরে নিয়া কর অন্তর্জলী।।

হেনকালে প্রভু নাটু সঙ্গে তাড়াতাড়ি।

উঠিতেছে হরিচাঁদ বিশেদের বাড়ী।।

বিশার জননী কাঁদে আগুলিয়া পথ।

বলে আজ ছেড়ে যায় তোর বিশ্বনাথ।।

আর কি করিবি খেলা ল’য়ে বিশ্বনাথে।

প্রভু বলে আইলাম বিশারে কিনিতে।।

ঠাকুর বলেন বিশে শীঘ্র উঠে আয়।

বয়ে যায় রাখালিয়া খেলার সময়।।

খেলা ছাড়ি কেন বা রইলি অন্তর্জলে।

অন্তর্জলে তুই দেখে মোর অন্তর জ্বলে।।

এত বলি হস্ত ধরি বিশারে তুলিল।

নিদ্রা ভঙ্গে যেন বিশে গোষ্ঠেতে চলিল।।

বিশ্বনাথ গোঠে গেল ঠাকুরের সঙ্গে।

রাখাল মণ্ডলে গিয়া খেলা করে রঙ্গে।।

উঠিল মঙ্গল রোল জুড়িয়া মেদিনী।

বাল বৃদ্ধ যুবা করে জয় জয় ধ্বনি।।

কেহ বলে রামকান্ত দিয়াছিল বর।

এ ছেলে মনুষ্য নয় ব্রহ্ম পরাৎপর।।

কেহ বলে যশোমন্ত অতি নিষ্ঠা নর।

তার পুণ্যে হ’ল কোন দেব অবতার।।

বিশ্বনাথ উপাখ্যান শুনে যেই জন।

শমনের ভয় তার হয় নিবারণ।।
মহানন্দ চিদানন্দ রচিতে পুস্তক।

প্রভুর পৌগণ্ড লীলা রচিল তারক।।

 

মহাপ্রভুর গোষ্ঠলীলা ও ফুলসজ্জা

পয়ার


পৌগণ্ড সময় করিতেন গোষ্ঠলীলা।

প্রথম কৈশোরে করিতেন সেই খেলা।।

রাখাল সঙ্গেতে করিতেন গোচারণ।

নূতন মাধুর্য খেলা খেলিত তখন।।

গোপাল রাখিতে হ’ত গোপাল আবেশ।

গোপালক সঙ্গে হ’ত গোপালের বেশ।।

খেলিতে খেলিতে সঙ্গীগণ সমিভ্যরে।

যাইতেন রত্নডাঙ্গা বিলের ভিতরে।।

বলিতেন সঙ্গীগণে থেকে বিলকূল।

উঠাইয়া আন গিয়া কস্তূরীর ফুল।।

আন ভাই অই ফুল আমি অঙ্গে পরি।

রাখালেরা এনে দিত কুসুম কস্তূরী।।

সেই কস্তূরীর ফুল পরিত কর্ণেতে।

পদ পরে পদ রেখে দাড়া’ত ভঙ্গিতে।।

বলিত রাখালগণে ওরে ভাই সব।

একবার কর সবে আবা আবা রব।।

ঠাকুরে ঘেরিয়া সবে দিত আবাধ্বনি।

গাভী বৎস্য নাচিত মধুর রব শুনি।।

বাঁকা সাজে দাঁড়াতেন কর্ণে ফুল দিয়া।

কটি বেড়ি দিত ফুল গুজিয়া গুজিয়া।।

উভ করি মস্তকেতে বাঁধিতেন চুল।

মাথা বেড়ি গুজে দিত কস্তূরীর ফুল।।

মনোহর বেশ দেখে কাঁদিত রাখাল।

গো-বৎস্য নাচিত চক্ষে অবিরত জল।।

কখন কখন ফুল আনিতেন নিজে।

অই ভাবে কস্তূরীর ফুল সাজে সেজে।।

বসিতেন গিয়া প্রভু রাখালের মাঝ।

ঠিক যেন বৃন্দাবনে রাখালের রাজ।।

পরিধান বসন জলেতে ভিজাইয়ে।

রাখালে প্রভুর পদ দিত ধোয়াইয়ে।।

ধোয়াইত পাদ-পদ্ম বস্ত্র চিপাড়িয়ে।

সেই ভিজা বসনেতে দিত মুছাইয়ে।।

সখাভাবে রাখালেরা করিত কাকুতি।

আমরা রাখাল তুই রাখালের পতি।।

জনমে জনমে ভাই সঙ্গেতে রাখিস।

এই ভাবে সাজিয়া মোদের দেখা দিস।।

এই ফুলে সাজিলে দেখায় কিবা শোভা।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

সঙ্গে রেখ হরিরে! গোচারণ-বিহারী।

এই খেলা খেলিতে আমরা যেন পারি।।

প্রভু বলে গরু রাখি রাখালের সনে।

রাখাল রাজার রূপ পড়ে মোর মনে।।

সেই রাখালিয়া ভাব ক্রমে হয় বৃদ্ধি।

কস্তূরীর ফুলে সাজি রাখালিয়া বুদ্ধি।।

তোমরাও যে রাখাল আমি সে রাখাল।

কলিতে কস্তূরী ত্রেতাযুগে নীলোৎপল।।

ত্রেতাযুগে পুঁজে রাম দেবীর চরণ।

দেবীদহ হ’তে করে এ ফুল চয়ন।।

মর্তে এসে নীলোৎপল হইল কস্তূরী।

সাধারণ লোকে বলে কচড়ী কচড়ী।।

কালগুণে মহতেরা তেজ লুকাইয়া।

গোপনে থাকেন তারা ঈশ্বর ভাসিয়া।। (ভাবিয়া)

তাহাতে কি মহতের মান কমে যায়।

জহরী জহর পেলে চিনে সেই লয়।।

মাঝে মাঝে শুনে থাকি গীত রামায়ণ।

শ্রীরাম দেবীর পুজা করিল যখন।।

করিলেন দেবীর পূজা সংকল্প করিয়া।

শতাধিক অস্টপদ্ম দিলেন গণিয়া।।

ফুল হেরে প্রসন্না প্রসন্নময়ী দুর্গে।

এক পদ্ম হরণ করিল পূজা অগ্রে।।

সবে বলে রাম প্রতি দেবী প্রতিকুল।

নতুবা বল কে নিল নীল পদ্ম ফুল।।

সেই পদ্ম রামচন্দ্র পূরণ করিতে।

উদ্যত হইল নীলপদ্ম চক্ষু দিতে।।

চক্ষু লক্ষ্য করি কমলাক্ষ জুড়ে বাণ।

বলে এই পদ্মে কর পূজা সমাধান।।

তাহা দেখি মহামায়া হ’য়ে তুস্টমতি।

বলে ক্ষান্ত হও শান্ত ওহে রঘুপতি।।

নীলপদ্ম দেখি মম প্রফুল্লিত মন।

তাই এক পদ্ম অগ্রে করেছি গ্রহণ।।

না পূজিতে অগ্রে পূজা ল’য়েছি তোমার।

হাতে ধরি হও ক্ষান্ত ওহে রঘুবর।।

এই সেই রাজীব হে রাজীবলোচন।

এই কীর্তি তোমার ঘষিবে ত্রিভুবন।।

অকাল বোধন করে রাম দয়াময়।

কস্তূরী কুসুম পেয়ে দেবী তুস্টা হয়।।

বসন্তে বাসন্তী দুর্গা পূজিত সবায়।

রাম হ’তে আশ্বিনে অম্বিকা পূজা হয়।।

সেই নীলপদ্ম ফুল এই কলিকালে।

কস্তূরীর ফুল বিলে সাজি সেই ফুলে।।

এ বড় দুঃখের ফুল দুঃখের সময়।

হৃদয় ধরিলে হয় ভক্তি প্রেমোদয়।।

তাহা শুনি রাখালেরা ডাকে মা মা করি।

প্রেমানন্দে বলে জয় রাম দুর্গা হরি।।

শ্রীহরি ফুলসজ্জা কস্তূরীর কুসুমে।

রাখালের আনন্দ যেন বৃন্দাবন ধামে।।

শ্রীহরির ফুলসজ্জা ভুবনমোহন।

হরি ঘেরি, করে সবে হরি সংকীর্তন।।

রত্নডাঙ্গা বিলকূলে রত্ন উপজিল।

তারকের মহানন্দ হরি হরি বল।।

মৃত্যুঞ্জয় আজ্ঞা দিল রচনা কারণে।

অপারক তারক রচিল তার গুণে।।

কতক দিনের পরে হইল রচনা।

হরিচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্বজনা।।

 

শ্রীগৌরাঙ্গের হস্ত গণনা।

পয়ার।


এমন আশ্চর্যলীলা সকলে দেখিল।

তবু প্রভু পেয়ে কেহ চিনিতে নারিল।।

হেন মায়া স্বয়ং এর যুগে যুগে আছে।

মানুষ লীলার বেলা কে কবে চিনেছে।।

বদনে ব্রহ্মাণ্ড দেখাইল যশোদারে।

বাৎসল্য তাচ্ছিল্যজ্ঞানে চিনিতে না পারে।।

যখন গৌরাঙ্গ রায় শচী মার ঘরে।

আমি সেই আমি সেই বলে বারে বারে।।

সুরধনী গঙ্গা জন্মে আমার চরণে।

ডুবিলি মায়ার কূপে আমারে না চিনে।।

নদীয়ার নর নারী শচীমাকে কয়।

পড়িতে পড়িতে উহার বায়ু ঊর্ধ্ব হয়।।

গ্রহণের বেড়ী ভব বন্ধন চরণে।

বিষ্ণুতৈল শিরে দেয় শিখার মুণ্ডনে।।

আপনি হইয়া শান্ত জগৎ রঞ্জন।

জ্যোতির্জ্ঞ পণ্ডিত কাছে দিল দরশন।।

সামুদ্রিক জানে ভাল হস্ত অঙ্ক দেখে। (জ্ঞানে)

তিন জনমের কথা বলে দেয় লোকে।।

তার ঠাই গিয়া বলে গৌরাঙ্গ সুন্দর।

তিন জনমের বার্তা কহত আমার।।

গণক বলেন আমি পাই গণনায়।

পূর্বে তুমি কৃষ্ণ ছিলে যশোদা তনয়।।

নন্দ নামে গোপ বৈশ্য ছিল তব পিতা।

আমার গণনা কভু না হইবে মিথ্যা।।

তা হইলে তুমি হও স্বয়ং অবতার।

এ গণনা ভুল অদ্য হ’য়েছে আমার।।

প্রভু কন হে ঠাকুর আর আছে কার্য।

এর পূর্বে কে ছিলাম করে দেহ ধার্য।।

গণক বলেন তবে ফিরে ধরি হাত।

এর পূর্ব জন্মে তুমি ছিলে রঘুনাথ।।

দশরথ পুত্র তুমি কৌশল্যা উদরে।

চারি অংশে জন্ম নিলা অযোধ্যানগরে।।

গণনাতে টের পাই তোমার যে নাম।

জগৎ মন রমতে তুমি ছিলে রাম।।

তা হইলে তুমি হও স্বয়ং অবতার।

নিশ্চয় গণনা ভ্রান্তি হ’য়েছে আমার।।

কালীয় দমন করে ডুবে কালীদয়।

রাণী ব’লে বাঁচাইল কাত্যায়নী মায়।।

যখন করেন লীলা মানব রূপেতে।

তখন তাঁহাকে কেহ না পারে চিনিতে।।

যোগে বসি ধ্যান করে যত মুনিগণ।

একা গর্গ ধ্যান করে জানিল তখন।।

কণ্বমুনি পারণা করিতে নিবেদয়।

আপনি আসিয়া কৃষ্ণ তার অন্ন খায়।।

ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে মুনিবর কয়।

গোয়ালের ছেলে মোর অন্ন মেরে দেয়।।

যশোদা রাখিল বেঁধে তবু এসে খায়।

ক্রোধ দেখি যশোদা ধরিল মুনি পায়।।

যশোদা বলেরে কৃষ্ণ অন্ন মার কেনে।

কৃষ্ণ বলে আমারে ডাকিল কি কারণে।।

গৃহে বাঁধা এক কৃষ্ণ আর কৃষ্ণ খায়।

তবু মুনি চিনিতে নারিল দয়াময়।।

বিস্ময় মানিয়া মুনি ধ্যানস্থ হইল।

ধ্যান করি বিশ্ব হরি তবে সে চিনিল।।

কার্যক্ষেত্রে তাঁহারে না চিনে কোনজন।

পূর্বেতে যেমন ভাব এখন তেমন।।

সেই মত লীলা করে যশোমন্ত সুত।

শুনিতে তাঁহার লীলা বড়ই অদ্ভুত।।

শ্রবণে কলুষ ক্ষয় গোলোকেতে বাস।

কৃষ্ণভক্তি লাভ হয় কর্মকাণ্ড নাশ।।

পাপে ধরা পরিপূর্ণ পাপাচ্ছন্ন তায়।

মন্দ সন্দ অন্ধকারে হরি চন্দ্রোদয়।।

শ্রীহরি চরিত্র সুধা রসনা রসিল। (রচিল)

হরি প্রেমানন্দে সবে হরি হরি বল।।

 

জ্ঞানযোগ ও রস প্রকরণ।

পয়ার।


শ্রীরামে যখন বিশ্বামিত্র ল’য়ে গেল।

স্বয়ং জানিয়া তবু মন্ত্র শিক্ষা দিল।।

তাড়কা বধিতে যবে রাম ছাড়ে বাণ।

বিশ্বামিত্র কেন ভীত হইল অজ্ঞান।।

পারে কিনা পারে রাম বধিতে তাড়কা।

তিন জনে খাইবেক যদি পায় দেখা।।

যদ্যপি বৈকুণ্ঠপতি বিষ্ণু অবতার।

তথাপি শ্রীরামরূপে মানুষ আকার।।

যখন বশিষ্ঠ মুনি অভিষেক করে।

সাগরের জলে স্নান করা’ল রামেরে।।

চারি সাগরের জল মুনি আনাইল।

শ্রীরামে ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান করাইল।।

যদ্যপি জানেন রাম সংসারের সার।

তথাপি করা’ল রামে মানুষ আচার।।

লীলার সময় সবে তেমতি জানিবে।

স্বয়ং জানিলে সেও নরভাবে ভাবে।।

ভূ-ভার হরণ তার প্রতিজ্ঞা সমস্ত।

অসুরের মুণ্ডচ্ছেদ ধরি ধনু অস্ত্র।।

গৌরাঙ্গ লীলায় দয়া অস্ত্র ধনু ধরি।

কলির কলুষ নাশ করিল শ্রীহরি।।

লিখিলেন গোস্বামীরা অস্ত্র সাঙ্গোপাঙ্গ।

করিলেন পাষণ্ড দলন শ্রীগৌরাঙ্গ।।

ধন্য লীলা প্রেম-ভক্তি করিল প্রকাশ।

রামচন্দ্র নরোত্তম প্রভু শ্রীনিবাস।।

তবু নাহি গেল বৈষ্ণবের কুটিনাটি।

জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড বিষয় ভ্রুকুটি।।

বৈষ্ণবের পক্ষে হরি ভকতি বিলাস।

লিখিলেন গ্রন্থ কবিরাজ কৃষ্ণদাস।।

তাহার মধ্যেতে প্রকাশিল বিধি ভক্তি।

বিধি ভক্তে নাহি হয় ব্রজভাব প্রাপ্তি।।

স্বয়ং এর শ্রীমুখের বাক্য নিদর্শন।

চৈতন্য চরিতামৃত মঙ্গলাচরণ।।

এবে দয়া প্রকাশিয়া প্রভু হরিচাঁদ।

বৈষ্ণবের কাটিলেন নাম অপরাধ।।

জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড মুক্তি অষ্টপাশ।

দয়া সুদর্শনে কাটিলেন হরিদাস।।

ভক্তি অঙ্গ জানাইতে নাম হরিদাস।

আপনি আপনা লীলা করেন প্রকাশ।।

বিরাগ বিশুদ্ধ প্রেম ভক্তি  আচরণ।

রাগ ভক্তি দিয়া মাতাইল সর্বজন।।

গৃহে থেকে প্রেম ভক্তি সেই হয় শ্রেষ্ঠ।

অনুরাগ বিরাগেতে প্রেম ইষ্ট নিষ্ঠ।।

সাক্ষী তার কাশিখণ্ডে দেবতা সবাই।

শুনিলেন ধর্মকথা লোপামুদ্রা ঠাই।।

গৃহকর্ম রক্ষা করে বাক্য সত্য কয়।

বাণপ্রস্থ পরমহংস তার তুল্য নয়।।

গয়া গঙ্গা প্রয়াগ পুষ্কর দ্বারাবতী।

প্রভাস নর্মদা কুরুক্ষেত্র সরস্বতী।।

পৃথিবীর পুণ্য ক্ষেত্র আছে যত্র যত্র।

সব তীর্থ শ্রেষ্ঠ সে প্রয়াগ পুণ্যক্ষেত্র।।

যত যত তীর্থ আছে অবনী ভিতরে।

সত্য বাক্য সমকক্ষ হইতে না পারে।।

পর অন্ন খায়  যে বা তীর্থধামে যায়।

ষড়াংশের এক অংশ ফল সেই পায়।।

বাণিজ্য কারণে যে বা তীর্থধামে যায়।

তীর্থের নাহিক ফল বাণিজ্য সে পায়।।

দেহের ইন্দ্রিয় বশ না হয়েছে যার।

তীর্থে গেলে ফলপ্রাপ্তি না হইবে তার।।

দেহের ইন্দ্রিয় বশ করেছে যে জন।

তার দরশনে সব তীর্থ দরশন।।

গৃহেতে থাকিয়া যার ভাবোদয় হয়।

সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয়।।

অনুধ্বজ, শিখিধ্বজ, সুধন্বা, সুরথ।

অম্বরীষ, বিভীষণ, রঘু, ভগিরথ।।

প্রহলাদ, নারদ, শুক, ধ্রুব, মুচুকন্দ।

বিদুর, গুহক, বলী, শ্রীসহস্রস্কন্দ।।

এ সব গৃহস্থ নর বিধি ভক্তি রসে।

অন্তরঙ্গ ভক্ত সব থাকে গৃহবাসে।।

তার মধ্যে পঞ্চ অঙ্গ অতি অন্তরঙ্গ।

দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর পঞ্চঅঙ্গ।।

শান্তভাব নিষ্ঠা-বতী চারি রসে রয়।

শান্ত রস রতি নিষ্ঠা পঞ্চ অঙ্গ কয়।।

অনর্পিত চরিং চিরাৎ শ্লোকে বাখানি।

লিখে বিল্বমঙ্গল উজ্জ্বল নীলমণি।।

অতি অন্তরঙ্গ মধ্যে করিয়াছে ঠিক।

তিন প্রভু ছয় গোঁসাই পঞ্চ রসিক।।

ইহারা সকলে মাত্র গৃহাশ্রমী হয়।

গৃহত্যাগী শেষে হয় গোস্বামীরা ছয়।।

ঢাকিয়া রসিক ধর্ম গৃহধর্ম দিয়া।

অবনীতে অবতীর্ণ শ্রীহরি আসিয়া।।

গৃহধর্ম লভিবেক যজিবে যাজন।

অন্তরঙ্গ রসিক হইবে সেই জন।।

পূর্বে যার যেই পথ আছে জানাজানি।

এদানি লইবে তারে সেই পথে টানি।।

বিশ্বনাথে বাঁচাইয়া হরিচাঁদ নিল।

সেই বিশ্বনাথ শেষে দরবেশ হ’ল।।

করেছেন কত লীলা পৌগণ্ড সময়।

লিখিতে অসাধ্য মোর পুঁথি বেড়ে যায়।।

কিছুদিন পরে হ’ল গোচারণ সায়।

বিবাহ করিল প্রভু কৈশোর সময়।।

ঠাকুরের জন্ম অগ্রে পরে যে সময়।

রামকান্ত আসিতেন মোহান্ত আলয়।।

বৈরাগী ব্রাহ্মণ আদি অতিথি আসিত।

কারু না কহিত প্রভু নিজ মনোনীত।।

নিন্দা কি বন্দনা কারু কিছু না করিত।

রামকান্ত এলে গিয়া পদে লোটাইত।।

কিছু অন্তরেতে রামকান্তে ল’য়ে যেত।

দুই প্রভু একাসনে নির্জনে বসিত।।

রামকান্তে বলিতেন তুমি মম গুরু।

যুগে যুগে তুমি মোর বাঞ্ছাকল্পতরু।।

এইভাবে রামকান্তে করিতেন স্তুতি।

কথোপকথনে কাটাতেন দিবারাতি।।

প্রভু সব মনোবৃত্তি কান্তে জানাইল।

মধুময় শ্রীহরি চরিত্র হরিবল।।

 

অথ লক্ষ্মীমাতার জন্ম-বিবাহ ও যশোমন্ত ঠাকুরের তিরোভাব।

পয়ার।

জিকাবাড়ী নিবাসী লোচন প্রামাণিক।

একমাত্র কন্যা ভালবাসে প্রাণাধিক।।

বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী যিনি সত্যে বেদবতী।

অম্বরীষ কন্যা যিনি দ্বাপরে শ্রীমতি।।

বিষ্ণুপদ সেবানন্দ ক্ষীরোদ বাসিনী।

ত্রেতাযুগে সীতা সতী দ্বাপরে রুক্মিনী।।

বিষ্ণুপ্রিয়া নাম ধরে গৌরাঙ্গ গৃহিণী।

কলিতে হ’লেন তিনি লোচন নন্দিনী।।

যে কালে জন্মিল মাতা লোচনের ঘরে।

ভূমিষ্ঠ হ’লেন যবে সূতিকা আগারে।।

কি লিখিব কি লিখিব ভেবেছি বসিয়া।

শান্তিদেবী পদ ভাবি নয়ন মুদিয়া।।

অন্তর হইতে এক নারী বাহিরিল।

সেই নারী লক্ষ্মীমার ধাত্রী যেন ছিল।।

আমি যেন দেখিলাম বিভীষিকা প্রায়।

ধ্যানে কি স্বপনে দেখি বোঝা নাহি যায়।।

দেখিলাম শান্তিমার শান্তিময়ী পদ।

রাঙা চরণেতে ফুটিয়াছে কোকনদ।।

ধাত্রী দেখে কোকনদ উড়িয়া আসিল।

শান্তিমার শ্রীচরণে প’ড়ে লুটাইল।।

প্রসবিনী ফুলনাড়ি যবে প্রসবিল।

এক ফুল তথা হতে পদে লুকাইল।।

ইহা শুনিলাম যেন প্রলাপের প্রায়।

সজ্ঞানেতে লিখিলাম ধাত্রী যাহা কয়।।

ধাত্রী বলে প্রসূতিরে বলি মা তোমায়।

তোমার এ কন্যা মা সামান্যা কভু নয়।।

ধাত্রী কহিলেন লোচনের গৃহিণীরে।

লোচন-গৃহিণী কয় লোচনের তরে।।

শুনিয়া লোচন সব করিল প্রত্যয়।

এ মেয়ের যোগ্য বর পাইব কোথায়।।

নির্জনে বসিয়া করে ঈশ্বরের ধ্যান।

এই কন্যা কাহাকে করিব সম্প্রদান।।

বহু চিন্তা মনে মনে করিতে লাগিল।

এদিকেতে লক্ষ্মীমাতা বলিষ্ঠা হইল।।

বাল্যকালে যখনেতে করিতেন খেলা।

বালিকাগণের সঙ্গে করিতেন মেলা।।

আয় গো ভগিনী মোরা খেলিব সকলে।

সর্বমঙ্গলার পূজা করি সবে মিলে।।

সতীর বেদনা যানে সেই মাতা সতী।

পঞ্চতপা হইয়া পাইল পশুপতি।।

কল্য শাস্ত্র শুনিয়াছি বাবার গোচরে।

জগন্মাতা জন্ম নিয়াছিল গিরিপুরে।।

বাল্যকালে করিলেন তপস্যা আরম্ভ।

শিবপূজা করিলেন সদা অবলম্ব।।

তপস্যার ফলে পতি পায় কৃত্তিবাস।

সতীমার পূর্ণ হ’ল মনো অভিলাষ।।

একদিন আমার পিতার গুরু এল।

গোঁসাই বসিয়া কত শাস্ত্র শুনাইল।।

শুনিলাম কাত্যায়নী পূজে ব্রজঙ্গনা।

মাধব মাধব পয়ে পুরা’ল বাসনা।।

দয়মন্তী সতী শক্তি আরাধনা ফলে।

হংসমুখে বার্তা শুনি পতি পেল নলে।।

ভদ্রাবতী সতী বাহু রাজার নন্দিনী।

পাইল শ্রীবৎস পতি দৈববাণী শুনি।।

সাবিত্রীর ব্রত করে সতী সে সাবিত্রী।

মৃত্যুপতি জিনে, বাঁচাইল মৃত পতি।।

সাধনা বিহনে ভাল পতি মিলে কার।

আয় মোরা পূজা করি সর্বমঙ্গলার।।

বালিকাগণের সহ হইয়া একত্র।

আনিতেন দূর্বাদল তুলসীর পত্র।।

গৃহ হ’তে চেয়ে নিত আতপ তণ্ডুল।

তুলে নিত গ্রামে পেত যত যত ফুল।।

কুষ্মাণ্ড কাচড়া লাউ কলম্বী ধুতুরা।

মরিচ বেগুন বন্যা ফুল কেওয়া তারা।।

ফাল্গুনী সংক্রান্তি দিনে দ্বিজমন্ত্র বিনে।

পূজিতেন কাত্যায়নী ল’য়ে বালাগণে।।

তুলসী চন্দন মাখি’ যতন করিয়া।

কালী লও ব’লে দিত অঞ্জলী পুরিয়া।।

খেলিতেন ল’য়ে যত গ্রাম বালিকায়।

ইহার অগ্রেতে বাল্য খেলার সময়।।

বালিকা আচারে আলো তণ্ডুল বিহনে।

বালি দিয়া নৈবিদ্য সাজা’ত বালাগণে।।

বলিতেন এই মত তোরা সবে সাজা।

আয় লো ভগিনী মোরা খেলি পূজা পূজা।।

এরূপে পৌগণ্ডকাল হ’য়ে এল গত।

এমন সময় খেলে সাবিত্রীর ব্রত।।

কখন কখন ল’য়ে বালিকার গণ।

ভক্তিভাবে পূজিতেন দেব নারায়ণ।।

অম্বরীষ কন্যা শ্রীমতীরে তুমি নাও।

সেই মত দয়াময় মোরে ল’য়ে যাও।।

লোচন শুনিল দৈবে বাল্যখেলার ছলে।

যশোমন্ত পুত্র হরি বিশাকে বাঁচা’লে।।

চিত্ত চমকিত হ’ল মানিল বিস্ময়।

এ ছেলে ঈশ্বর অংশ সামান্য ত নয়।।

হরির সঙ্গেতে দিলে শান্তির বিবাহ।

ইহকাল পরকাল হইবে নির্বাহ।।

লোচন সফলাডাঙ্গা আসিয়া আসিয়া।

যশোমন্তে কথা কয় হাসিয়া হাসিয়া।।

তোমার মধ্যম পুত্র আমি তাঁরে চাই।

কন্যা দিয়া আমি তাঁরে করিব জামাই।।

শুনি যশোমন্ত বড় হ’ল আনন্দিত।

বলে এই কর্ম কর যে হয় উচিত।।

আসা যাওয়া দেখা শুনা হয় রীতিমতে।

কন্যাদান করিলেন শুভ সু-লগ্নেতে।।

যশোমন্ত বিয়া দিল পাঁচটি নন্দন।

অচিরাৎ লোকলীলা কৈল সম্বরণ।।

একদিন গাত্র শীত হৃদিকম্প হয়।

মুহূর্তেক বসিলেন তুলসী তলায়।।

জপিলেন ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর।

সজ্ঞানেতে দেহত্যাগী হ’ল লোকান্তর।।

পুষ্পরথে চড়ি সুখে গোলোকে গমন।

যশোমন্ত প্রীতে হরি বল সর্বজন।।

হরি পিতা লোকান্তর সমাধি শুনিলে।

পুলকে গোলোকে যাবে হরি হরি বলে।।

অন্তকালে হবে তাঁর হরি কর্ণধার।

বিরচিল রসরাজ কবি সরকার।।


0 comments:

Post a Comment

 
Top