পরিশিষ্ট খণ্ড
তৃতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।

(জয় শ্রীসুধন্যচাঁদ সভ্যভামাত্মজ।

প্রেমানন্দে হরি গুরু শ্রীপতিচাঁদ ভজ।।)

জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।

 

ভক্ত হরিপাল উপাখ্যান।

পয়ার

গোলোক পালের পুত্র হরিপাল নামে।

যশোহর অধীনে কেশবপুর গ্রামে।।

ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদ নিকটে না যায়।

উদ্দেশ্যে মতুয়া হ’য়ে হরিগুণ গায়।।

হরিপাল হরিবোলা হইয়া গিয়াছে।

মতুয়া বলিয়া নাম প্রচার হ’য়েছে।।

এই সময়েতে তার হ’য়েছিল জ্বর।

জ্বরেতে অজ্ঞান প্রায় হইয়া বিকার।।

তার পিতা ভয় ভীত হইয়া মনেতে।

ডাক্তার আনিতে যায় ঔষধ খাওয়াতে।।

অমনি চৈতন্য হ’য়ে হরিপাল কয়।

হরিবোলা হ’য়ে কি ঔষধ খাওয়া যায়।।

হরিবোলা হ’য়ে যেবা ঔষধ খাইল।

জানিবে সে হরিবোলা সেদিন মরিল।।

তবে যদি বাঁচে কোন ঔষধি খাইয়ে।

সে বাঁচা সে মিছা বাঁচা বাঁচে কি লাগিয়ে।।

আমি তারে মনে করি জ্ঞান প্রাণ হত।

মায়াদেহ কায়া যেন ছায়াবাজী মত।।

না রহে নৈষ্ঠিক তার নাম নিষ্ঠা হারা।

দিন দুই চারি খেলা জীয়ন্তে সে মরা।।

ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদ হ’য়েছে উদয়।

পতিত পাবন প্রভু বড় দয়াময়।।

যাই যাই ভাবি আমি যাইতে না পারি।

শ্রবণে শুনেছি নাম চক্ষে নাহি হেরি।।

না দেখিতে পারিলাম প্রভুর শ্রীঅঙ্গ।

হেনকালে শুনিলাম লীলা হ’ল সাঙ্গ।।

গোলোকের নিত্যধন গেলেন গোলোকে।

উদ্দেশ্য ভাবি শ্রীপদ মনের পুলকে।।

শুনেছি সাধুর মুখে কহে পরস্পর।

অধর ধরিবি যে ধরেছে তারে ধর।।

অধর মানুষ যে ধরেছে ধরাপর।

মানুষ পড়িবে ধরা সে মানুষ ধর।।

সূর্যনারায়ণ খুড়া ডুমুরিয়া আছে।

ঠাকুরের কথা শুনিয়াছি তার কাছে।।

আমারে বাঁচাও যদি ওঢ়াকাঁদি যাও।

হুকুম আনিয়া পিতা আমাকে বাঁচাও।।

চলিল গোলোক পাল ওঢ়াকাঁদি যেতে।

ডুমুরিয়া গেল সূর্যনারায়ণে নিতে।।

কহিল আমার সাথে যেতে হবে ভাই।

হরিপুত্র গুরচাঁদে আনিবারে যাই।।

সূর্যনারায়ণ এল হরি হরি বলে।

তেতুল গুলিয়া খাওয়াইল হরিপালে।।

কাঁচি দধি পান্তাভাত খাওয়াইয়া দিল।

কাঁচা জলে স্নান জ্বর ধুয়ে ফেলাইল।।

সূর্যনারায়ণ ল’য়ে পরামর্শ করে।

বল খুড়া ওঢ়াকাঁদি যাই কি প্রকারে।।

হরিচাঁদ জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রভু গুরুচাঁদ।

সে প্রভু কেমন আমি দেখিব সে পদ।।

করিলেন দিন ধার্য ওঢ়াকাঁদি যেতে।

ঠিক হ’ল সূর্যনারায়ণ যা’বে সাথে।।

একখানা নৌকা আছে বাওয়ালে পাঠাবে।

নৌকা চালাইয়া শেষে ওঢ়াকাঁদি যাবে।।

নৌকার চালান দিল বাওয়ালেতে গেল।

বাদায় সুন্দরী বনে গাছ কাঁটা ছিল।।

চাঁদপাই দক্ষিণে সে সুন্দরীর চক।

সেখানে কাটিল গাছ মনেতে পুলক।।

গদাই নামেতে সেই বাওয়ালির পাড়া।

সেই চকে গাছ কাটে পড়ে গেল সাড়া।।

এদিকেতে ওঢ়াকাঁদি মানসী করিয়া।

পাড়ার বাওয়াল সবে কাঠ কাটে গিয়া।।

কাটিয়া কাটিয়া নিয়া নৌকায় বাঁধিল।

বাবা হরিচাঁদ বলি নৌকা ছেড়ে দিল।।

সে পাড়ার নৌকা ছিল অষ্টাদশ খান।

সব নৌকা সায়রে জোয়ারে দিল টান।।

চিলা হতে নৌকা ছাড়ে জোয়ারের গোণে।

রাত্রি দেখে নৌকা রাখে মাকড়ের টোনে।। (ঢোনে)

নৌকা রেখে সবে ঘুমাইল বিহুঁশিতে।

ভাটা লেগে তরণী ডুবিল অর্ধ রাতে।।

বাওয়ালিরা চারিজন নায় বাঁধে কাঁছি।

চেঁচা চেঁচি করে বলে কিসে মোরা বাঁচি।।

ভোর রাত্রি চারিজন অন্য নায় উঠে।

বাড়ী এসে বলে হরিপালের নিকটে।।

দিন ভরে অনাহারে হরিপাল রয়।

বাবা হরিচাঁদ বলে কাঁদে সর্বদায়।।

হত্যা দিয়ে থাকে শুয়ে দেখিল স্বপন।

স্বপ্নাদেশে কহে এসে সূর্যনারায়ণ।।

আর না কাঁদিস বাছা হ’য়ে অর্থলোভী।

চলে যা নৌকার কাছে নৌকা গাছ পাবি।।

সেই সব ভাগিদের সঙ্গেতে করিয়া।

ডোবা নৌকা যথা তথা উত্তরিল গিয়া।।

সেই খানে গাঁঠ বাঁধা নৌকা বার খান।

কেঁদে কহে হরিপাল বাওলির স্থান।।

কাছি বাঁধা খুঁটিগাড়া নোঙ্গর যে ছিল।

তাহা উধঘাটিয়া নৌকা মধ্য গাঙ্গে এল।।

গদাই বাওয়ালি অন্য লোক ল’য়ে ব’সে।

নৌকা উঠাইয়ে নিবে করে পরামিশে।।

হরিপাল বলে সেই বাওয়ালির ঠাই।

আমি মোর ডোবা নৌকা তুলে নিতে চাই।।

গদাই বলেছে নৌকা বাদায় ডুবিলে।

কোন বেটা নৌকা পাইয়াছে কোন কালে।।

কুম্ভীর জলেতে লোনা কাঙ্গট হাঙ্গর।

এই স্থান হ’তে নৌকা কে উঠাবে তোর।।

হরিপাল বলে যদি তুলে দাও নৌকা।

তুমি মোর ধর্মপিতা দিব কুড়ি টাকা।।

গদাই বলেছে তুমি কেন পিতা কও।

ইচ্ছা থাকে কুড়ি টাকা তুমি ল’য়ে যাও।।

তাহা শুনি হরিপাল নিরস্ত হইল।

নিজে নৌকায় এসে রাত্রিতে রহিল।।

বাবা হরিচাঁদ বলে ছাড়ে ঘন হাই।

শেষ রাত্রে চেঁচাইয়ে উঠিল গদাই।।

হেনকালে শব্দ উঠে নৌকা ঠেকাঠেকি।

জল শব্দ উঠে ঢেউ নৌকা ঢকঢকি।।

গদাই বাওয়ালি বলে সবে শুনে নেও।

উঠাও পালের নৌকা যদি ভাল চাও।।

এ নৌকা না উঠাইলে কারু বাঁচা নাই।

নতুবা সকল নৌকা ডুবিবে এ ঠাই।।

ব্যাঘ্রে চড়ি উগ্র এক মানুষ আসিয়ে।

প্রকাণ্ড শরীর তার কহে হুঙ্কারিয়ে।।

শীঘ্র করি এই তরী প্রভাতে উঠাও।

নৈলে ডুবাইব সব বাওয়ালির নাও।।

রাত্রি পোহাইল সবে করে ডাকাডাকি।

গদাই বাওয়ালি বলে তোরা আয় দেখি।।

জলে নক্র কে ডুবিবে কে বাঁধিবে কাছি।

হরিপাল বলে আমি নিজে ডুবিতেছি।।

ভাটার সময় ডুব দিল হরি বলে।

এক ডুবে কাছি বাঁধি উঠিলেন কূলে।।

হরিপাল বলে কাছি উপরে থাকুক।

ক্ষণেক বিলম্ব কর জোয়ার আসুক।।

বাবা হরিচাঁদ বলে উৎকণ্ঠিত প্রাণ।

ছয় জনে কাছি ধরি দিল এক টান।।

হাল দাঁড় বাঁধা গাছ নোঙ্গর সহিতে।

জাগিয়া উঠিল নৌকা ছই ছাপ্পরেতে।।

গদাই বাওয়ালি বলে কিছুকাল রও।

ভাটা হ’লে আপনি জাগিবে এই নাও।।

জল ফেলাইল সবে ভাটার সময়।

সেঁচা হ’য়ে পূর্ববৎ নৌকা ভেসে রয়।।

গদাই বাওয়ালি তার এ বার্ষিক আছে।

একটি মানুষ দেয় শার্দূলের কাছে।।

হরিপাল যবে নৌকা খুলিবারে চায়।

সেই দিন বাঘের বার্ষিক দিতে হয়।।

গদাই বাওয়ালি বলে হরিপাল শুন।

টাকা দিবা বলেছিলে দেহ টা এখন।।

হরিপাল বলে টাকা দিব কি কারণ।

নৌকা উঠাইয়া দিলে দেখিয়া স্বপন।।

শুনিয়া গদাই রাগ হ’ল অতিশয়।

মৌখিকেতে সাধুভাষা হরিপালে কয়।।

আশা ছিল হরিপাল দেশে ফিরে যাবে।

তারপর গদাই সে নৌকা তুলে নিবে।।

তাহা নাহি হ’ল আরো টাকা নাহি দেয়।

জানে প্রাণে মারিব যেমন দুরাশয়।।

গদাই বলেছে হরি ধর্মপুত্র তুমি।

চল বাছা চক দেখাইয়া আনি আমি।।

সাধুর তরণী কভু মারা নাহি যায়।

তোমা হ’তে এই কথা হইল প্রত্যয়।।

নৌকা পেলে গাছ পেলে বাপরে আমার।

আমার যা আছে তাহা সকলি তোমার।।

কতকগুলি গাছ কাঁটা আছে এই চকে।

মম সঙ্গে চল বাছা দিব তা তোমাকে।।

ধর্মপুত্র, তুমি, তোমা বড় ভালবাসি।

চল যাই তোমাকে দেখায়ে ল’য়ে আসি।।

এই গাছ দেশে ল’য়ে ওরে বাবা।

এই গাছ নামাইয়া সেই গাছ নিবা।।

এত বলি দুইজনে চড়ি ডিঙ্গিনায়।

হরিপালে লইয়া গদা বাদা মধ্যে যায়।।

দুই তিন জোলা খাল পার হ’য়ে গেল।

দুর্গম বাদার মধ্যে হাঁটিয়া চলিল।।

হরিপাল বলে ওরে গদাই বাওয়ালি।

কই তোর কাঁটা গাছ কোথা ল’য়ে আলি।।

গদা বলে হরিপাল বুঝিতে না পার।

সময় থাকিতে পরকাল চিন্তা কর।।

আমার নিয়ম আছে বার্ষিক এ স্থান।

একটি মানুষ দেই বাঘের যোগান।।

সেই জন্য আসিয়াছি তোমারে লইয়ে।

তোরে দিয়ে সেই বার্ষিক যাব শোধ হয়ে।।

হরিপালে ধরে তথা বসাইয়া রাখে।

দূরে গিয়ে গদাই চালান মন্ত্র ডাকে।।

বসিলেন হরিপাল নয়ন মুদিয়া।

মরিলাম হরিচাঁদ বিদেশে আসিয়া।।

কেন মোরে বাদায় পাঠালে স্বপ্নাদেশে।

রাখ মহাপ্রভু আমি মরিনু বিদেশে।।

এ বিপদে যদি পদে স্থান নাহি দিবে।

অকলঙ্ক নামে তব কলঙ্ক রহিবে।।

বাঘে খাবে এত ভাবি ছেড়ে দিল দেহ।

চক্ষেধারা জ্ঞান হারা পড়ে দিল মোহ।।

কতক্ষণ তথা অচৈতন্য হ’য়েছিল।

দৈবে এক মহা পুরুষ তথায় আসিল।।

হরিপালে উঠাইল ধরে দুই হাতে।

বলে আমি আসিয়াছি ওঢ়াকাঁদি হ’তে।।

ভয় নাই বাছারে নয়ন মেলে থাক।

গদাই কি করে তাহা ব’সে ব’সে দেখ।।

হরি গ্রীবা পরে হরি বসে পাছা দিয়ে।

দুই দিকে দুইপদ বক্ষে ঝুলাইয়ে।।

দাঁড়িয়ে রহিল এক লৌহ গদা হাতে।

হরিপাল বসিয়া রহিল নির্ভয়েতে।।

উরুযুগ বক্ষে চাপি বঙ্কিম জঙ্গায়।

যেন নরসিংহ মূর্তি ভয়ংকর কায়।।

হরিপাল বাহুযুগে উরু চাপি ধরি।

শ্রীচরণে হেরি দুনয়নে বহে বারি।।

জীবমানে হেরি নাই শ্রীচরণ তরী।

দেখিব দেখিব মনে আশা ছিল ভারি।।

সেই আশা পূর্ণ হ’ল নৌকা বিসর্জনে।

বর্তমানে দেখিলা গদাইর গুণে।।

মৃত্যুঞ্জয় বিরচিত স্তোত্র গীতি যাহা।

অঙ্গ চিহ্ন লক্ষণাদি দেখিলাম তাহা।।

মন্ত্র পঠি ডাকে গদা হ’ল এক শব্দ।

ভূমিকম্পে প্রায় শব্দে বনজন্তু স্তব্ধ।।

সব পক্ষী উড়িল নিদান ডাক ছাড়ি।

চকের মধ্যেতে যেন মহা হুড়াহুড়ি।।

ভীষণ শার্দূল এক তথায় আসিয়া।

হরিপাল সম্মুখে পড়িল লম্ফ দিয়া।।

ব্যাঘ্র এসে অল্প মাত্র রহিল তফাৎ।

ব্যবধান অনুমান চারি পাঁচ হাত।।

লক লক জিহ্বা একহাত পরিমাণ।

লালাইছে বাহির করিয়া জিহ্বা খান।।

গর্জন করিছে ব্যাঘ্র হেন জ্ঞান হয়।

ভীমনাদে মহাক্রোধে মাটি ফেটে যায়।।

দণ্ডচারি এইরূপে গর্জন করিল।

লম্ফ দিয়া দৌড়াইয়া ব্যাঘ্র পালাইল।।

গদাইর দিকেতে হইল ধাবমান।

তাহা দেখি উড়ে গেল গদাইর প্রাণ।।

শঙ্কা পেয়ে গদাই কহিছে অতঃপরে।

বলে বাবা হরিপাল রক্ষা কর মোরে।।

না বুঝিয়া হেন কার্য করিয়াছি তোমা।

তুমি সাধু হরি ভক্ত মোরে কর ক্ষমা।।

তুমি মম পিতা হও আমি তব ছেলে।

মরেছি মরেছি বাবা রাখ পুত্র বলে।।

আর আমি আসিব না বাওয়াল করিতে।

এইবার বাঁচাইয়া লহরে দেশেতে।।

স্কন্ধে থেকে প্রভু ডেকে বলে হরিপালে।

বাঁচাইয়া লহ ওরে হ’ল যদি ছেলে।।

এ বেটারে যদি অদ্য বাঘে ধরে খাবে।

দুর্গম বাদার পথ কে দে’খায়ে ল’বে।।

হরিপাল আজ্ঞা দিল ব্যাঘ্র ফিরে গেল।

ভয় নাই বলিয়া গদারে আশ্বাসিল।।

দয়া করি গদাইর প্রাণ দান করি।

তরীতে আসিল হরি বলে হরি হরি।।

পুনর্বার সায়রে জোয়ারে দিল টান।

এক সঙ্গে ভাসাইল তরী তের খান।।

খুলনা আসিল যবে ট্যাক্সের অফিসে।

হরিপালের নৌকা সকলের পাছে আসে।।

ট্যাক্স ঘাটে সকলের নৌকা লাগাইল।

বিশ ত্রিশ টাকা প্রতি  নৌকায় লাগিল।।

হরির তরণী না রাখিল ট্যাক্স ঘাটে।

নিজ ঘাটে নৌকা বেয়ে এল নিঃসঙ্কটে।।

এইসব আশ্চর্য কার্যে বিস্ময় মানিল।

তারপর শ্রীশ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি গেল।।

উত্তরিল ওঢ়াকাঁদি মনের আহলদে।

সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গুরুচাঁদ পদে।।

মনের বাসনা যাতে ধন বৃদ্ধি হয়।

মনে মনে ভাবিলেন যাত্রার সময়।।

দেখা মাত্র গুরুচাঁদ বলিল বচন।

হরিবল হরি তব বাড়িবেক ধন।।

মনো কথা যত তার মনে মনে ছিল।

গুরুচাঁদ শ্রীচরণে সব নিবেদিল।।

ক্রমেতে সম্পত্তি তার বাড়িতে লাগিল।

হরিচাঁদ নামে বহু লোক মাতাইল।।

কতক খাতক হ’ল বহু শিষ্য হল।

অন্য জাতি স্বজাতীয় লোক মাতাইল।।

অর্জুন মাতিল আর নাগর বণিক।

হরিচাঁদ প্রেমে লোক মাতিল অধিক।।

হরিচাঁদ প্রেমে গুরুচাঁদের ভাবেতে।

মাতাইল পাল বংশ অনেক গ্রামেতে।।

পালপাড়া শুক্তাগ্রাম আর কুলুখালি।

ঘসিবেড়ে দিঘলীয়া মাতে হরি বলি।।

হরিপালের চরিত্র বিচিত্র অদ্ভুত।

শ্রবণে কলুষনাশ হারে রবিসুত।।

যেবা শুনে গায় হয় দুস্তারে নিস্তার।

হেন মধু পিও সাধু জন্ম নাহি আর।।

হরি প্রেম সাগরে সাঁতারে সাধুলোক।

শ্রীহরি চরিত্র সুধা ক্ষুধার্ত তারক।।

 

ভক্তগণ প্রমত্ত।

পয়ার

মল্লকাঁদি নিবাস ছাড়িয়া মৃত্যুঞ্জয়।

কালীনগরেতে বাস প্রভুর আজ্ঞায়।।

যে কালেতে মৃত্যুঞ্জয় এল এই দেশে।

সূর্যনারায়ণ মত্ত প্রথমত এসে।।

তারপরে মাতিল তারক সরকার।

কাশীমাকে মা বলিয়া পদ কৈল সার।।

তারকের জন্মদাতা পিতা কাশীনাথ।

মাতা অন্নপূর্ণা দেবী তস্য গর্ভজাত।।

গুরু মৃত্যুঞ্জয় গুরুমাতা কাশীশ্বরী।

নামে নামে মেশামেশি এক জ্ঞান করি।।

আরো হরিচাঁদ নামে গুণ প্রকাশিয়া।

প্রথমতঃ হরিপদ দিল দেখাইয়া।।

উপদেষ্টা গুরু বলি মানিল তারক।

তাহা দেখি এদেশে মাতিল বহুলোক।।

ব্রাহ্মণ কায়স্থ পাল কুণ্ডু নমঃশূদ্র।

জাতি নানাবিধ যত ছিল ভদ্রাভদ্র।।

মাতিল চন্দ্র মল্লিক অতি নিষ্ঠারতি।

হ’ল যেন কাশীমার গর্ভজ সন্ততি।।

মত্ত রাধানাথ চন্দ্র মল্লিকের শিশু।

খাসিয়ালী নিবাসী নবীন চন্দ্র বসু।।

পিরিতিরামের পুত্র দক্ষিণ বাড়ীতে।

কুলিনের বংশে জন্ম কায়স্থ কুলেতে।।

কাশীমাকে মা বলিয়া পূর্ণ মাতৃভাব।

হরিপাল সঙ্গেতে হইল সখ্যভাব।।

তারকেরে গুরু মানি প্রিয় শিষ্য হ’ল।

সাধনা দেবীকে গুরু মা বলে ডাকিল।।

শ্রীঅক্ষয় চক্রবর্তী পবিত্র ছিণ্ডিয়ে।

হরিপ্রেমে মেতে গেল উদাসীন হ’য়ে।।

মহানন্দ আজ্ঞাক্রমে তারকে ধরিল।

আত্ম সমর্পণে গুরু বরণ করিল।।

সাধনাকে গুরুমাতা করিল বরণ।

“কামবীজ” ”কাম গায়ত্রী” ক’ল গ্রহণ।।

গাছবাড়ী গ্রামে মাতে চন্দ্র রামধন।

বহুজন মাতাইল তারা দুইজন।।

মাহিষ্য মাধব দাস গাছবেড়ে গ্রামে।

সিকদারোপাধী মত্ত হরিচাঁদ প্রেমে।।

হরিচাঁদ গুরুচাঁদ বলে সারে রোগী।

গুরুচাঁদ প্রিয় ভক্ত গাঢ় অনুরাগী।।

মনপ্রাণ সপিয়াছে গুরুচাঁদ পায়।

স্নান সন্ধ্যা বিবর্জিত প্রেমোন্মত্ত কায়।।

মাতিল মাহিষ্য দাস দাসের ময়াল।

তার মধ্যে মাধব করেন ঠাকুরাল।।

কপালী ময়াল মধ্যে করে ঠাকুরালি।

যোগানিয়া গ্রামে ভক্ত নিমাই কপালী।।

তার প্রতি মাধবের দয়া উপজিল।

তার বাড়ী ঠাকুরের আসন পাতিল।।

শ্রীগুরুচাঁদের নামে করিল ঔদাস্য।

তাহারা সকলে হ’ল তারকের শিষ্য।।

মাতিল কালিয়া গ্রামে বিপ্র পঞ্চানন।

বড় অধিকারী তিনি ভকত সুজন।।

ভট্টাচার্য উপধিক শ্রেষ্ঠ শ্রেণী রাঢ়ী।

ভক্ত সঙ্গে যান রঙ্গে ওঢ়াকাঁদি বাড়ী।।

দোঁহাই শ্রীগুরুচাঁদ বলে রোগী সারে।

মানসিক টাকা দেন শ্রীগুরুচাঁদেরে।।

গুরুচাঁদ নামে ঘট পাতে ঠাই ঠাই।

আমবাড়ী গ্রামে ঘট পাতিল গোঁসাই।।

তেরখাদা রজবংশী মাতিল সকল।

মুসল্মান তিনকড়ি বলে হরিবোল।।

তেরখাদা ঘট পাতে রাজবংশী বাড়ী।

পাতিল দোসরা ঘট মাঞ্জের বাড়ী।।

সাহাজাতি পুরুষ প্রকৃতি মাতিয়াছে।

তারকেরে গুরু বলে নাম লইয়াছে।।

তেরখাদা ঘাটের পাটনী বনমালী।

ডুমুরিয়া তার বাড়ী মাতে হরিবলি।।

ইতিপূর্বে জয়পুর প্রহলদ পাটনী।

খেয়াঘাটে ধ্বনি (অগ্নি) জ্বেলে পো’হাত অগিনি।।

গ্রীষ্মকালে অগ্নি জ্বেলে প্রখর রৌদ্রেতে।

জপিত শ্রীহরিনাম বসে সেখানেতে।।

গোস্বামী গোলোক এসে তাহা নিষেধিল।

শেষে নামে মত্ত হ’য়ে নিদ্রা তেয়াগিল।।

তেরখাদা মাতাইল বহু সাধু লোক।

মাতিল সাহাজী শশী হৃদয় তারক।।

কি কহিব ইহাদের ভকতির কথা।

অতি সাধ্বী সতী নারী ইহাদের মাতা।।

হৃদয় শশীর পিতা মহা অনুরাগী।

হরিচাঁদ প্রিয় ভক্ত যেন মহাযোগী।।

ওঢ়াকাঁদি ভক্ত পেলে করে শিরোধার্য।

মন প্রাণ দেহ দিয়া করে সেবা কার্য।।

পঞ্চানন ঠাকুরের মহিমা অপার।

হরিভক্তি শিখাইয়া মাতাল সংসার।।

দুর্গাপুর মাতে হরিবর মনোহর।

তারকের শিষ্য তারা ভক্ত প্রিয়তর।।

মহাকবি দুই ভাই ভক্ত চূড়ামণি।

উভয়ে কবি আখ্যা কবি চূড়ামণি।।

তারকের বাঁধা পদ কাজ কি মন্ত্রবীজে।

পদ শুনে হরিবর সন্ধ্যাহ্নিক ত্যজে।।

মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের স্তোত্র গীতি যাহা।

ত্রি-সন্ধ্যা আহ্নিক তার মূলমন্ত্র তাহা।।

তারকের স্তবাষ্টক নিজকৃত স্তব।

(এক লাইন গ্যাপ)

গুরুচাঁদ আজ্ঞামতে শ্রীতারক গুরু।

মহানন্দ শ্রীতারক বাঞ্ছা কল্পতরু।।

চণ্ডীচরণের পুত্র যাদব মল্লিক।

মৃত্যুঞ্জয় ভাগ্নেয় তারক প্রাণাধিক।।

বিশ্বাস যাদব চন্দ্র সাধু শুদ্ধমতি।

তাহার লোহার গাতী গ্রামেতে বসতি।।

দুই যাদবের এই রচনার প্রীতি।

সকৌতুকে পরিশ্রম করিয়াছে অতি।।

যাদব বিশ্বাস হয় এ গ্রন্থ লেখক।

মল্লিক লেখায় তাঁরে হইয়া পাঠক।।

লেখক যাদব ইনি পর উপকারী।

বহুদিন লেখে গ্রন্থ কার্য ত্যাগ করি।।

দলিল লিখিতে নাহি মোহরানা লয়।

দরিদ্রের পিতৃতুল্য দয়ার্দ্র হৃদয়।।

দেশের প্রধান ব্যাক্তি শালিসী করয়।

সুবিচার করে কারু ঘুষ নাহি খায়।।

একদিন স্বজাতির সমাজে গেলেন।

কৌলীন্য মর্যাদা পাঁচ টাকা পাইলেন।।

মান্য পেয়ে পরে টাকা ফিরাইয়া দিল।

কোন ক্রমে দাতারা সে টাকা নাহি নিল।।

দায় ঠেকে টাকা লয়ে এল নিজালয়।

গ্রাম্য বারোয়ারী কালী পূজাতে লাগায়।।

নিজের চাঁদার টাকা অগ্রে তাহা দিল।

আরো সেই পাঁচ টাকা সবে সমর্পিল।।

বলে এই টাকা নিলে মহা পাপ হয়।

এই ভয় নিমন্ত্রণ খাইতে না যায়।।

এইরূপ শুদ্ধ শান্ত পুরুষ রতন।।

এই রচনার তার বড়ই যতন।

এই গ্রন্থ লেখার কালে মকর্দমা ছিল।

টাকা জন্য বাড়ী যা’বে তারকে জানাল।।

তারক বলিল ধর এই টাকা লও।

ফিরায়ে নিব না টাকা অদ্য হেথা রও।।

শুনিয়া যাদব অধোবদনে রহিল।

বাক্য নাহি অশ্রুজলে ভাসিতে লাগিল।।

অর্থ দিবে এই ভয় লুকাইয়া গেল।

যাদব মল্লিক গিয়া খুঁজিয়া ধরিল।।

বলে এই ভাগবত করিব লিখন।

কর্তা মোরে অর্থ সাধে কিসের কারণ।।

স্নান না করিব আমি জল না খাইব।

অনাহারে আমি ছার জীবন ত্যজিব।।

তারক যাদব পরে বহু বুঝাইল।

নিবৃত্ত হইল কিন্তু মনে দুঃখ র’ল।।

এই প্রেমে মাতিয়াছে মত্ত মাতোয়াল।

দীনজনে দয়া করে পরম দয়াল।।

আরো কত জন মাতে আইচ পাড়ায়।

মাতোয়ারা রাজেন্দ্র আইচ মহাশয়।।

মহামান্য যুধিষ্ঠির বিশ্বাস সুজন।

তস্য পুত্র রজনী বিশ্বাস মত্ত হন।।

রাজেন্দ্র চিকিৎসা করে অর্থ নাহি লয়।

এবে কিছু কিছু লয় তারক আজ্ঞায়।।

হরিবর সরকার পূর্বেতে লিখিত।

লেখক যাদব হ’ন তস্য বংশজাত।।

হরিবর যাদবের হন খুল্লতাত।

পুনর্বার এই গ্রন্থ তার করাঙ্কিত।।

বর্ণশুদ্ধি সংশোধক এই হরিবর।

বহু পরিশ্রম করি লিখে চারিবার।।

জয় জয় গৌরচন্দ্র রূপ হরিশ্চন্দ্র।

জয় জয় হরিচাঁদ রূপ গুরুচন্দ্র।।

জয় নিত্যানন্দ প্রভু রূপ মহানন্দ।

জয় জয়াদ্বৈত শক্তি শ্রীগোলোকচন্দ্র।।

সবাকার আজ্ঞাবহ দাস এ তারক।

লীলামৃত গ্রন্থ লিখিবারে অপারক।।

দশরথ গোলোকের আজ্ঞা শিরোধার্য।

কলিকল্পতরু গ্রন্থ শেষ লীলা পূজ্য।।

আদেশে এ দাস এই গ্রন্থ বিরচিল।

হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।।

প্রভুর কৃপায় গ্রন্থ হ’ল সমাপন।

হরিচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্বজন।।


0 comments:

Post a Comment

 
Top